বাংলাট্রিবিউন:

রোহিঙ্গাদের ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিবন্ধন করে পরিচয়পত্র দেওয়া হচ্ছে গত ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে। ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৫ দিনে ২৭ হাজার ৪৭১ জনকে পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে। এখন নিবন্ধনের কাজ চলছে তিনটি কেন্দ্রে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব হারানো রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সংগ্রহের ব্যস্ততা, নিবন্ধনের বিষয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, অবকাঠামোগত ও কারিগরি সমস্যার কারণেই মূলত বায়োমেট্রিক নিবন্ধন ধীরগতিতে চলছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আঙ্গুলের ছাপ ও ছবি সম্বলিত এই পরিচয়পত্র হলে রোহিঙ্গারা কখনও জালিয়াতি করে জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট তৈরি করতে পারবে না। স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট সফটওয়্যার তাদের ধরে ফেলবে। অবশ্য এর আগে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে পাসপোর্ট তৈরি করে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছে। ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অনেকেই ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের হাতে যাতে বাংলাদেশি পাসপোর্ট না যায় সেটি নিশ্চিত করতেই এই বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) টেকনাফের নয়াপাড়া নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে দেখা যায়, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের ব্যবস্থাপনায় বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় রোহিঙ্গাদের নাম নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র দেওয়া হচ্ছে। নারী ও পুরুষদের আলাদা লাইনে দাঁড় করিয়ে প্রথমে একটি সিরিয়াল নম্বর দেওয়া হচ্ছে। তবে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের লাইনে তেমন ভিড় দেখা যায়নি। মাত্র শ’ খানেক রোহিঙ্গা লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন পরিচয়পত্র নেওয়ার জন্য।

রোহিঙ্গাদের ডিজিটাল নিবন্ধন (ছবি: নুরুজ্জামান লাবু)রোহিঙ্গাদের ডিজিটাল নিবন্ধন (ছবি: নুরুজ্জামান লাবু)

এই ক্যাম্পের তত্ত্বাবধায়ক ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের উপ-পরিচালক সাঈদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিদিন ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত নাম নিবন্ধন করা হচ্ছে। নয়াপাড়া ক্যাম্প ছাড়াও কুতুপালং ও ঠেংখালি ক্যাম্পে এই কার্যক্রম চলছে। রোহিঙ্গাদের নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম, কত তারিখে এসেছে, মিয়ানমারে তাদের বাড়ির ঠিকানা লিপিবদ্ধ করার পাশাপাশি ছবি ও আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে পরিচয়পত্র দেওয়া হচ্ছে। তাৎক্ষণিক পরিচয়পত্র প্রিন্ট করে লেমিনেটিং করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

পাসপোর্ট অধিদফতরের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘ডিজিটাল পদ্ধতিতে নাম নিবন্ধন করার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর দুই দিনে সফটওয়্যার তৈরি করে কাজ শুরু করা হয়েছে। ধীরে ধীরে সেন্টার বাড়ানো হচ্ছে। তবে অবকাঠামোগত সমস্যা, বিদ্যুৎ না থাকা এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাবে একটু ধীর গতিতে কাজ চলছে। তবে খুব শিগগিরই কেন্দ্র বাড়ানোসহ আরও দ্রুত নাম নিবন্ধন করার জন্য জোর প্রচেষ্টা চলছে।’

তবে ১৫ দিনে মাত্র ২৭ হাজার রোহিঙ্গা নিবন্ধিত হওয়ার কাজ সমাপ্ত হওয়ার সময় নিয়ে কিছুটা উদ্বেগও তৈরি হয়েছে। গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে যে পাঁচ লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে, তাদের নিবন্ধন করতে এক বছরেরও বেশি সময় লেগে যাবে ধারণা করছেন অনেকে।

এদিকে কর্মকর্তা ও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডিজিটাল পদ্ধতিতে নাম নিবন্ধন করার বিষয়ে তেমন আগ্রহ নেই রোহিঙ্গাদের মধ্যে। অনেকে আবার বিষয়টি সম্পর্কে কোনও কিছু জানেই না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ক্যাম্পগুলোতে এ নিয়ে তেমন কোনও প্রচারণাও নেই।

নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের রাজু নামে এক তরুণ বলেন, ‘অনুপ্রবেশের পর রোহিঙ্গারা প্রথমে থাকার জন্য একটি আশ্রয় তৈরি করে। তারপর থেকে প্রতিদিনই তাদের দুবেলা খাবারের জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। ত্রাণ সহায়তা না পেলে থাকতে হয় অনাহারে। এই অবস্থায় মানুষ খাবারের জন্য দৌড়াবে নাকি নাম নিবন্ধন করতে যাবে?’

রোহিঙ্গাদের ডিজিটাল নিবন্ধন (ছবি: নুরুজ্জামান লাবু)রোহিঙ্গাদের ডিজিটাল নিবন্ধন (ছবি: নুরুজ্জামান লাবু)

নিবন্ধন সেন্টারের একজন কর্মকর্তা জানান, ত্রাণ সহায়তার জন্য প্রশাসন ও সেনাবাহিনী যৌথভাবে কাজ করলেও এখনও পুরোপুরি শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। যদি এমন ঘোষণা দেওয়া হয় যে নতুন করে নিবন্ধন ছাড়া কেউ ত্রাণ সহায়তা পাবে না তাহলে সবাই আগে নাম নিবন্ধন করবে। এই উদ্যোগ কার্যকর করতে পারলে রোহিঙ্গাদের মধ্যে নিবন্ধিত হওয়ার প্রবণতা বাড়বে।

কর্মকর্তারা আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিবন্ধন করার জন্য প্রতিটি নতুন ক্যাম্পেই এই কেন্দ্র চালু করা প্রয়োজন। তাহলে দ্রুত নিবন্ধন করা সম্ভব হবে। তা  না হলে ধীরে ধীরে রোহিঙ্গারা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। নিবন্ধন করা না হলে তারা দালালদের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট বানিয়ে ফেলতে পারে। বিষয়টিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আরও বেশি নজর দেওয়া প্রয়োজন। তারওপর আগে আসা পুরনো রোহিঙ্গাদেরও এখনও ডিজিটাল পদ্ধতিতে কোনও ডাটাবেজ তৈরি করা হয়নি।

ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা একই সঙ্গে নিবন্ধন সেন্টার বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এছাড়া রোহিঙ্গাদের এই নাম নিবন্ধনের বিষয়টি যাতে বাধ্যতামূলক করা যায় সেই ব্যবস্থাও করছি। এতে কম সময়ে সব রোহিঙ্গাকে নিবন্ধনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।’

সরকারি-বেসরকারি হিসেবে গত ২৫ আগস্টের পর থেকে অন্তত পাঁচ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। এছাড়া আগে থেকেই আরও অন্তত পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় ক্যাম্প করে বসবাস করছে।